সহজ বাংলায় প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টের আদ্যোপান্ত

প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কাকে বলে? সংজ্ঞাসহ উদাহরণ দাও। একজন প্রোজেক্ট ম্যনেজারকে এই প্রশ্ন করলে তিনি কি উত্তর দিবেন? প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে এই আর্টিকেল লেখার আগে আমাদের মাথায় ঠিক এই প্রশ্নটাই ঘুরছিল। তারপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রোজেক্ট ম্যনেজারের সাক্ষাৎকার ঘেঁটে আমরা বেশকিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি…

প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বুঝতে আমাদের আগে জানতে হবে, প্রোজেক্ট কাকে বলে? সোজা বাংলায় প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট এর অর্থ দাঁড়ায় সুপরিকল্পিত কার্যক্রম। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্যে বিভিন্ন ধরণের সীমাবদ্ধতার কথা (যেমন: কাজের খরচ বা ব্যয়, কাজের মূল উদ্দেশ্য) মাথায় রেখে একটি কাজ বা প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শেষ করতে আমরা যে ধরণের পরিকল্পনা ও পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাই তাকেই প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট বলে। অন্যভাবে বলতে গেলে, একটি প্রোজেক্ট হচ্ছে অনেকগুলো পরিকল্পিত কাজের সমষ্টি। আর তাই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, জ্ঞান, পদ্ধতি, কৌশল এসবই প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টের অংশ।

প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে:

  • আরম্ভ করা (Initiating)
  • পরিকল্পনা করা (Planning)
  • পরিকল্পনা কাজে প্রয়োগ করা (Executing)
  • কাজের তত্ত্বাবধায়ন ও তদারকি করা (Monitoring and controlling)
  • ঠিকভাবে শেষ করা (Closing)

তবে এর সঙ্গে একজন প্রোজেক্ট ম্যানেজারকে খেয়াল রাখতে হবে আরও দশটি বিষয়:

  1. সঠিক সমন্বয় (Integration)
  2. সুযোগ (Scope)
  3. সময় (Time)
  4. খরচ বা ব্যয় (Cost)
  5. কাজের মান (Quality)
  6. প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ (Procurement)
  7. জনবল (Human resources)
  8. পারস্পরিক যোগাযোগ (Communication)
  9. ঝুঁকি মোকাবেলা (Risk management)
  10. ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ (Stakeholder Management) 

এসব কিছু ম্যানেজ করে চলাটাই প্রোজেক্ট ম্যানেজারের কাজ। আর সেজন্যে তাকে বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর তাই যেকোন কাজের জন্য সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন করতে হলে কাজের ধরণ, প্রতিষ্ঠানের চাহিদা বা গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক খেয়াল রাখার পাশাপাশি, কাজের সঙ্গে যুক্ত সবার দক্ষতা এবং ব্যক্তি ও সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোও খেয়াল রাখতে হয়।

তাহলে একটি প্রকল্প সফলভাবে সম্পাদন করতে একজন প্রোজেক্ট ম্যানেজারকে কি কি করতে হবে?

  • শুরুতেই প্রোজেক্ট বা কাজের মূল লক্ষ্যে বা উদ্দেশ্য স্থির করতে হবে
  • নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় ধাপ বা কাজগুলো নির্ধারণ করতে হবে
  • কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বা সরঞ্জামের তালিকা করতে হবে
  • পুরো প্রকল্প বা প্রত্যেকটি কাজ শেষ করতে কত খরচ বা সময় লাগবে তা নির্ধারণ করতে হবে
  • প্রকল্পের ঝুঁকিগুলো খুঁজে বের করে সেসব মোকাবেলার পরিকল্পনা করতে হবে
  • প্রকল্প চলাকালীন সব কাজ তদারকি করা ও নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হবে
  • প্রত্যাশা অনুযায়ী সঠিকভাবে প্রকল্প শেষ করতে হবে।

এবারে জেনে নিন বাজে প্রোজেক্ট ম্যানেজারেরে ৩টি  বৈশিষ্ট্য:

  • লোকজনকে হুকুমদারি করা বা আদেশ দেয়া (সেনাবাহিনীর প্রোজেক্ট হলে অবশ্য আলাদা ব্যাপার!)
  • সহকর্মীদের হুমকিধামকি দেয়া বা শাস্তির ভয় দেখানো
  • অযথা বাজে ব্যবহার করা (তবে সামান্য ঠাট্টা মস্করা করা যেতেই পারে)

আর ভালো প্রোজেক্ট ম্যানেজারের গুণ ৭টি হলো:

  • সবার সঙ্গে ভদ্র ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা
  • প্রয়োজনে ভালো উপদেশ দেয়া
  • কাজের ভুলত্রুটি শুধরে দেয়া ও ভালো কাজে প্রশংসা করা
  • সবাইকে উৎসাহিত করা
  • প্রয়োজনে সহকর্মীদের কাজে সাহায্য করা ও তাদের কাজের মান যাচাই করে দেখা
  • প্রোগ্রামিং সংশ্লিষ্ট প্রোজেক্ট হলে প্রোগ্রামাদের কোডিং ঠিকভাবে কাজ করছে কি না তা চেক করে দেখা ও প্রয়োজনে দ্রুত কাজ করতে তাগাদা দেয়া
  • কেউ যেন কাজে ফাঁকি না দেয়, সেদিকে খেয়াল রাখা।

কাজের সুবিধার জন্যে অনেক সময় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের গতি বাড়াতে এজাইল (Agile) প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট নীতি অনুসরণ করা হয়। এতে যে অবকাঠামো (Framework) সাধারণত বেশি  ব্যবহার হয় তাকে বলা হয় স্ক্রাম (Scrum)। এক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি প্রোজেক্ট ম্যানেজারের হিসেবে নিযুক্ত থাকেন না বরং একটি দলের সবাই প্রোজেক্ট ম্যানেজারেরে বিভিন্ন দায়িত্ব ভাগ করে পালন করেন। এদের মধ্যে কেউ স্ক্রাম মাস্টার (Scrum Master) ও কেউ প্রোডাক্ট ওউনার (Product Owner) পদে থাকেন। এজাইল প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টে অল্প সময়ে দ্রুত ফলাফল আশা করা হয়। আর তাই পণ্যের মান ঠিক রাখার পাশাপাশি সবাইকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ও ভুলত্রুটি শুধরে কাজ এগিয়ে নিতে হয়। একটি স্ক্রাম প্রোজেক্টে ৩টি পদ থাকে প্রোডাক্ট ওউনার অর্থাৎ পণ্য বা সফটওয়্যারের মালিক, স্ক্রাম মাস্টার অর্থাৎ যিনি কাজের তদারকি করবেন এবং দলের সাধারণ সদস্য। এছাড়াও অনেক সময় এ ধরণের অবকাঠামোতে কাজের পণ্য বা সফটওয়ারের কাজগুলো ব্যবহারকারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা হয়, যেন প্রোডাক্ট বা সফটওয়্যার যিনি তৈরি করবেন তিনি সহজেই নির্দেশনা বুঝে দ্রুত কাজ করতে পারেন। এক বলা হয় এজাইল ইউজার স্টোরি (Agile User Stories)।

প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টের সফটওয়্যার:

কাজের অবকাঠামো ও পরিকল্পনা তৈরি, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও প্রয়োগ নিশ্চিত করা, বিভিন্ন মিটিংয়ের সময় নির্ধারণ ও যোগাযগের সুবিধার জন্য প্রোজেক্ট ম্যানেজাররা প্রায় সময় বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকেন। এর ফলে প্রকল্পের খরচ নিরূপণ করা, পণ্যের মান যাচাই ও সব কাজের অগ্রগতির রেকর্ড রাখা সহজ হয়। অনেকসময় ম্যানেজারের সঙ্গে প্রকল্পের অংশীদাররাও এর মাধ্যমে যোগাযোগ রাখেন। এসব সফটওয়ারের কাজ অনেকটা এরকম

  • প্রোজেক্ট প্ল্যানিং: এর মাধ্যমে পরিকল্পনা করা ও প্রত্যেকের কাজ নির্ধারণ করা হয়।
  • টাস্ক ম্যানেজমেন্ট: সহকর্মীদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া, কাজের সময়সীমা নির্ধারণ ও অগ্রগতি যাচাই করতে এটি ব্যবহার হয়
  • ডকুমেন্ট এডটিং এন্ড কোলাবরেশন: এর মাধ্যমে প্রকল্পের অংশীদার ও অন্যান্যদের সঙ্গে জরুরী নথি ও কাগজপত্র শেয়ার করা হয়।
  • ক্যালেন্ডার এন্ড কন্টাক্ট শেয়ার: এর মাধ্যমে বিভিন্ন মিটিংয়ের সময় ঠিক করা, গুরুত্বপূর্ণ তারিখ নির্ধারণ করা ও সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
  • বাগ এন্ড এরোর ম্যানেজমেন্ট: এর মাধ্যমে মূলত সফটওয়্যারের ভুলত্রুটি যাচাই করা হয়
  • প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য একটি জনপ্রিয় সফটওয়্যার হচ্ছে পিভোটাল ট্র্যাকার। এছাড়াও এয়ারটেবিল, ট্রেলো, টিমগ্যান্টস ইত্যাদি সফটওয়্যারও পছন্দ করেন অনেকে।

যদিও প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট পুরোপুরি বোঝার জন্য একটি আর্টিকেল পড়া কোনভাবেই যথেষ্ট নয়, তবে এখানে খুব সংক্ষেপে এর মূল বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো মাত্র। যারা নতুন কোন প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছেন বা প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টে তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই মূলত তাদের জন্যে আর্টিকেলটি কাজে আসবে। আর কাজ শুরু করলে বাকিটা নিজেই বুঝতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন ধৈর্য, মনোযোগ আর কঠোর পরিশ্রম এই তিনটি গুণ আপনাকে সফল প্রোজেক্ট ম্যানেজার হতে সাহায্য করবে।