আরাফাত ভাইয়ের দুটি গুণ। এক – তিনি প্রচুর পরিশ্রম করতে পারেন, আর দুই – তার প্রেম নিখাঁদ আর অটল। যদিও তার প্রেম আর দশটা প্রেমের মত না।
আরাফাত ভাইয়ের প্রেম বিরিয়ানির সাথে। প্রবলভাবে। একদিন তিনি স্থির করলেন যে সেরা বিরিয়ানিটা তার চাইই চাই, তা সে যে করেই হোক। অনেক বিরিয়ানি চেখে দেখলেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই মনস্থির করতে পারলেন না সেরা কোনটা।
বিরিয়ানি-প্রিতী আর পরিশ্রম – এই দুই গুণের শুভমিলন হল সেইদিন, যেদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে সেরা বিরিয়ানিটা খেতে হলে সেটা নিজ হাতে বানাতে হবে, এক্কেবারে গোড়া থেকে।
যে ভাবা সেই কাজ। আদা-জল আর অল্প বিরিয়ানি খেয়ে তিনি নেমে পড়লেন কাজে।
প্রথম কাজ হল রান্নায় হাত পাকানো। তিনি ডিম ভাজি আলুভর্তা পারেন, মাংস রেঁধেছেন বার তিনেক। এতে চলবে না। তিনি মা আর দাদীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন সারা বছরের জন্য। বছর শেষে সেরা বিরিয়ানিটা তার নাগালের বাইরে থাকলেও সব্বাই তার রান্না খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কিন্তু আরাফাত ভাইয়ের প্রেম অটল, তিনি লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি।
এবার তিনি মন দিলেন বাজারে। তার মা আর দাদী দুজনেই একমত যে বাজার ভাল না হলে রান্না ভাল হবে না। কিন্তু বেশ কিছুদিন বাজার করে আর দোকানীদের সাথে আলাপ করে তিনি বুঝলেন যে বাজার বেজায় ঝামেলাপূর্ণ এক জায়গা। তার উপর সেরাদের সেরা জিনিসগুলো বাজারে উঠেই না।
এভাবে আর যাই হোক, সেরা বিরিয়ানি হবে না। সেরা বিরিয়ানির জন্য চাই সেরা মাংস, সেরা মশলা, সেরা চাল। আর এগুলো নিশ্চিতভাবে পাওয়া সম্ভব শুধু নিজের ক্ষেত-খামারেই।
এবারে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন আরাফাত ভাই। রান্না, হাটবাজার, সবই নাহয় মানা গেল। কিন্তু চাষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। ভাল ফসল, ভাল গরু পালন, এসবে অনেক অনেক সময় আর দক্ষতা প্রয়োজন।
এইভাবে এগোতে থাকলে তাকে সার উৎপাদন, গরুর দেখাশোনা ইত্যাদি কাজও শিখতে হবে। তার মানে যত চেষ্টাই তিনি করেন না কেন, সারাজীবন পরিশ্রম করেও তিনি একেবারে সেরা বিরিয়ানিটা পাবেন না। শেষমেশ বিষয়টা তিনি বুঝলেন।
আরাফাত ভাই ফুডপান্ডায় কাচ্চি অর্ডার দিলেন। ২০ মিনিটে খাবার হাজির। ঘি এর ঘ্রানে ভরা বাসমতি চালের সাথে নরম মাংস আর একটুখানি আলু মুখে যাওয়া মাত্র তিনি বুঝলেন যে নাগালের মধ্যের সুস্বাদু বিরিয়ানিটাই সর্বশ্রেষ্ঠ বিরিয়ানি।
গোড়াপত্তন? নাকি গোঁয়ার্তুমি?
একেবারে গোড়া থেকে শুরু করাটা অধিকাংশ সময়েই বোকামি।
কাজে গোলমাল বেঁধে গেলে আমরা বলে বসি ‘গোড়ায় গলদ, আবার শুরু করতে হবে।’ কথাটা অনেক সময়ে সত্য বটে, কিন্তু অধিকাংশ সময়েই না। একটু চিন্তা করলেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে গলদটা শুধু গোড়ায় না, আগা থেকে গোড়ার মাঝে যেকোন জায়গাতেই হত পারে!
সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই গোড়াপত্তন করেন এমন নয়। অধিকাংশ সৃষ্টিশীল মানুষ কার্যকর, সফল আইডিয়াগুলো জোড়া দেন। এভাবে একের পর এক সফল আইডিয়া জোড়া দিয়ে এমন এক মালা গাঁথেন যা বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।
তার কারণটাও খুব সোজা। পুরাতন আইডিয়া সময়ের কষ্টিপাথরে মসৃণ হয়ে বর্তমানে এসেছে। নতুনভাবে কিছু ভেবে বের করলে সেটা পুরানো আইডিয়াগুলোর মত এত কার্যকর নাও হতে পারে।
সমস্যা সমাধান যখন উদ্দেশ্য, তখন আইডিয়া নতুন না পুরানো তাতে খুব একটা যায় আসে না।
বিষয়টা আজ থেকে এমন তা কিন্তু নয়। শত সহস্র বছর ধরে সৃষ্টিশীল আর চমকপ্রদ কাজগুলো এভাবেই হয়ে আসছে। বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প – সবকিছুর ইতিহাসেই দেখা যায় সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষগুলো তার পূর্বসূরীদের কাজ জোড়া দিয়ে আর কেটেকুটে সমসাময়িক যুগের উপযোগী করে তুলেন। নাগালের মধ্যের উপকরণ দিয়ে তৈরি বিরিয়ানিই যে সেরা, এটা উনারা বুঝতেন।
বর্তমান দুনিয়া খুবই জটিল। প্রতিটা জিনিস অন্য সব জিনিসের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, আপাতদৃষ্টিতে মনে না হলেও। তাই একেবারে গোড়ায় গলদ ভেবে গোড়া থেকে শুরু করাটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সময় নষ্ট ছাড়া কিছুই না।
বর্তমান জগতের জটিলতার সাথে পাঞ্জা লড়ে বিজয়ী হওয়া সম্ভবও না, প্রয়োজনও নেই। বরং জটিলতাটুকু নিজের অনুকূলে ব্যবহার করা তুলনামূলকভাবে সহজ। কার্যকরীও বটে।
এটা যে শুধু মানবসমাজের বৈশিষ্ট্য তাও না। ধারাটি প্রকৃতিতেও দেখা যায়। প্রাচীন আমলের প্রাণীগুলো হুট করে আজকের রূপ নেয়নি। এমিবা থেকে ডাইনোসর আর ডাইনোসর থেকে পাখি হয়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে, নাগালের মাঝের অর্থাৎ পারিপার্শ্বকের সম্পদটুকুর সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে।
ঠিক এই কারণে বর্তমান জগতের জটিল সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একেবারে গোড়া থেকে শুরু করা বোকামি। শ্রেষ্ঠ ফলাফলের জন্য নাগালের মধ্যে যা আছে তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে।