সাফল্যের চাবিকাঠি ঘুম

কি ভাবছেন? সারাজীবন পড়লাম কি না পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি আর এরা বলছে ঘুমাতে! আপনি ঠিকই পড়েছেন। আপনার সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে পর্যাপ্ত ঘুমের ওপরেই। তবে এটা আমাদের কথা না, গবেষণার তথ্য। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যত ধরণের কাজ করি তার সবকিছু আমাদের মেধা ও দক্ষতার উপর নির্ভরশীল। আর এই সক্ষমতা আসে আমাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বা স্থিতিশীলতা থেকে। যার সঙ্গে পর্যাপ্ত ঘুম সরাসরি জড়িত। কারণ পরিমিত ঘুম আমাদের মনকে স্থির রাখে, মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে, মানসিক চাপ কমায় আর ধৈর্য বাড়ায়। ফলে আমাদের কাজের সফলতার হার অনেকাংশে বেড়ে যায়।

আমরা অনেকেই কমবেশি ঘুমাতে পছন্দ করি। যদিও ঘুমের স্বাস্থ্যগত উপকারগুলো সম্পর্কে অনেকেরই  কোন ধারণা নেই। গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের কর্মদক্ষতা মানসিক চাপ দাড়াও নানাভাবে প্রভাবিত। এই মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় কাজের চিন্তা, মাসিক বিলের চিন্তা, পরিবার-সম্পর্কের চিন্তাসহ নানা পারিপার্শ্বিক কারণে। তাহলে আমরা এই চাপ কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? উত্তর একটাই, ভালো করে ঘুম দেন। দেখবেন সব সমস্যা সমাধান হয়ে গেছে। কি বিশ্বাস হচ্ছে না? চলুন তাহলে বিস্তারিত জেনে নেই…

 মনোযোগ বাড়াতে ঘুমাতে হবে

আপনি যত বেশি ক্লান্ত থাকেন, মনোযোগ ধরে রাখতে আপনার ঠিক ততটাই কষ্ট হয়। এই যেমন ধরুন লং রুটের ড্রাইভাররা যারা আন্তঃজেলা বাস চালায়, তাদের কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই এরা এক্সিডেন্ট করে। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে একটানা দীর্ঘক্ষণ কাজ করা কষ্টকর। এছাড়াও বিরতিহীন কাজ করলে চট করে মেজাজ হারানোটাও স্বাভাবিক। তাই মাথা ঠাণ্ডা রাখাটা যেমন জরুরি। তার জন্য ঘুমটাও অতি প্রয়োজনীয়। কাজের সময় ধৈর্য বাড়াতে তাই আগের দিন ভালো করে ঘুমিয়ে নিন। নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত ঘুম আপনাকে ঠিকই লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। কোন এক্সিডেন্ট ছাড়াই!

 পর্যাপ্ত ঘুম চাপ নিতে সাহায্য করে এবং কর্মদক্ষতা বাড়ায়

রাতে ঠিকমতো ঘুম না হলে মানুষ অল্পতেই বিরক্ত হয়ে পড়ে।  গবেষণায় দেখা গেছে, অপর্যাপ্ত ঘুম মানুষকে অধৈর্য করে ফেলে, ফলে আমাদের মধ্যে সবকিছুর প্রতি নেতিবাচক অসহিষ্ণু মনোভাব সৃষ্টি হয়। ‘ভাল্লাগে না’ নামক যে ব্যাধিতে আমরা অনেকেই আক্রান্ত তার কারণ কিন্তু ঘুমের অভাবও হতে পারে। ঘুমের ঘাটতি থাকলে অল্পতেই আমরা নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। সাধারণত পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৭ ঘণ্টার কম ঘুমালে তার মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কমে যায়। এ কারণে সে অল্পতেই রেগে যায়। এছাড়াও ঘুম কম হলে দেখা দিতে পারে উচ্চ রক্তচাপসহ নানা শারীরিক সমস্যা।

 ঘুমের ঘাটতি আপনার চিন্তাশক্তি ভোঁতা করে দেয়

কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করি, পরিকল্পনা করি। এর জন্য মাথা ঠাণ্ডা থাকা দরকার। যেকোন সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য মস্তিস্কের সঠিক ব্যবহার প্রয়োজন। কিন্তু ঘুম কম হলে আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা কমে যায়। চিন্তার গভীরতা না থাকায় আমাদের কাজগুলো অনেকক্ষেত্রেই অপরিকল্পিত হয়। প্রত্যাশিত ফলও পাওয়া যায় না। ফলে কাজের মানও কমে যায়।

 তাহলে আমরা কিভাবে পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে পারি? আপনার ঘুম ঠিকঠাকমতো হচ্ছে কি না কিভাবে বুঝবেন? ভালো ঘুমের জন্য কিছু দরকারি টিপস দিয়ে দিচ্ছি:

আপনার শোবার জায়গাটি আরামদায়ক কি না সেটি যাচাই করুন

আপনার খাট ঠিক কতটা আরামদায়ক? আপনি যে ম্যাট্রেস বা বিছনায় ঘুমান সেটি কিন্তু আপনার ঘুমকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। ভালো ঘুমের জন্য দরকার আরামদায়ক এবং স্বাস্থ্যকর বিছানা। তাই ভালোমতো ঘুমানোর জন্য ভালো মানের ম্যাট্রেস কিনুন। আর কেনার সময় নিশ্চিত করুন যে ম্যাট্রেসটি যেন আপনার বিছানার আকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আরামদায়ক, হালকা আর শরীরের গঠনের জন্য উপযুক্ত ম্যাট্রেসই আপনাকে দিতে পারে নির্বিঘ্ন ঘুমের নিশ্চয়তা। 

নিয়মিত স্বাস্থ্যকর খাবার খান

আমাদের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে ঘুমের সরাসরি সম্পর্ক আছে। শরীরের অবস্থার উপরেই ঘুমের মান নির্ভর করে। হজম প্রক্রিয়ার সঙ্গেও ঘুমের যোগাযোগ আছে। ঘুমের সময় মানুষের শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশ্রামে থাকে তাই ঘুমের আগে ভারী খাবার না খাওয়াই ভালো। বিশেষজ্ঞরা বলেন ঘুমের অন্তত দু ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খেয়ে নেয়া উচিৎ। এতে করে পাকস্থলী খাবার হজমে পর্যাপ্ত সময় পায়।  যেসব খাবার হজম হতে বেশি সময় নেয় সেগুলো রাতে ঘুমানোর আগে না খাওয়াই ভালো। তাই ফাস্ট ফুড আর বাইরের খাবারও আপনার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই ভালো ঘুমের জন্য রাতের খাবারের পুষ্টিগুণ যাচাই করে নেয়া খুব জরুরি। 

প্রতিদিন একই সময় ঘুমাতে এবং ঘুম থেকে উঠতে চেষ্টা করুণ

অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন গভীর ঘুম একটি নিয়মিত অভ্যাসের ফল। ঘুমের রুটিন ঠিকমতো না মেনে চললে তাই গভীর ঘুম না হওয়াটাই স্বাভাবিক। দেরিতে ঘুমাতে গেলে বা ঘুম পুরো হওয়ার আগেই জোর করে উঠার চেষ্টা করলে সেটি শরীরের উপরে বিরূপ প্রভাব ফেলে। ফলে সারাদিন ক্লান্ত লাগে।

এছাড়াও ভালো ঘুমের জন্য আরও কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। যেমন:

ঘুমের আগে নিশ্চিত হন আপনি ক্লান্ত কি না কিংবা ঘুমের প্রয়োজন আছে কি না। আপনি যদি দিনের বেলায় অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকেন তাহলে রাতে ঘুম দেরিতে আসাটাই স্বাভাবিক। একইসঙ্গে শরীরে ক্লান্তি না থাকলে বিশ্রামেরও প্রয়োজন থাকে না। অর্থাৎ আপনি যদি শারীরিক পরিশ্রম না করেন বা দিনে অল্প কিছুক্ষণ ব্যায়াম না করেন অথবা সারাদিন বিশ্রামেই থাকেন, তাহলে ঘুম কিছুটা হালকা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ঘুমের আগে মানসিক চাপমুক্ত হবার চেষ্টা করুন। দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন, শরীরকে চাঙ্গা রাখুন। অন্যথায় অতিরিক্ত চিন্তা আপনার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে এমন কিছু অভ্যাস গড়ে তোলা উচিৎ যা আপনার দেহ ও মনকে চাপমুক্ত রাখবে। এই কাজগুলো প্রতিদিনই আপনাকে করতে হবে। তাহলে দিনের এই নির্দিষ্ট সময়টিতে আপনার শরীর এবং মন্তিষ্ক বুঝতে পারবে যে তার ঘুমাোর সময় হয়েছে। এসব অভ্যাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো: বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা, যেমন হালকা গরম পানিতে শরীর ভিজিয়ে নেয়া, মেডিটেশন করা বা একান্তচিত্তে প্রার্থনা করা,  কাছের মানুষের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা, বই পড়া, ঘরের আলো কমিয়ে ফেলা, ডায়েরি লেখা, কয়েক ঘণ্টার জন্য টিভি, স্মার্টফোন ও সব ধরণের ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি। তাই ঘুমকে অগ্রাধিকার দিন, দেখবেন জীবন বদলে গেছে।