রিয়েল লাইফ মাল্টিটাস্কিং: একসঙ্গে অনেক কাজ করছেন? নাকি অনেক পিছিয়ে পড়ছেন?

আপনি কি নিজেকে একজন মাল্টিটাস্কার মনে করেন ? একসঙ্গে অনেক কাজ করায় দক্ষ আপনি? তাহলে আপনার জন্য এক বালতি সমবেদনা। বিজ্ঞান বলছে, মানুষের মস্তিষ্ক একটা নির্দিষ্ট সময়ে কেবল একটা কাজেই মনোযোগ দিতে পারে। অর্থাৎ আমরা যদি নিজেকে একটা ক্যামেরার সঙ্গে তুলনা করি। তাহলে আমরা যে জিনিসটার ছবি তুলছি সেটিতে ফোকাস করলে যেমন সেটি ছাড়া চারপাশের সবকিছু আবছা হয়ে যায় তেমনি বাড়তি কাজগুলোও আমাদের মনের ফোকাসের এরিয়ার বাইরেই থেকে যায়। অর্থাৎ আপনি একসঙ্গে একাধিক কাজ করতে গিয়ে, কেবল একটা কাজই ঠিকমতো করতে পারছেন। বাকিগুলোর ফলাফল সবসময় প্রত্যাশিত ফল না-ও দিতে পারে। বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে একবার ভেবে দেখুন তো, রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলা নিষেধ কেন? কারণ, গাড়ি চালানো অবস্থায় ফোন রিসিভ করলে আমাদের কাছে ফোনে কথা বলাটাই বেশি জরুরী হয়ে পড়ে। ফলে রোড এক্সিডেন্টের ঝুঁকিটা অনেকাংশে বেড়ে যায়।

       আর তাই নিজেকে মাল্টিটাস্কার মনে করে আপনি যদি সব কাজ একসঙ্গে করবেন ভেবে কাজ জমাতে থাকেন। আর এর পরিণতিটাও কিন্তু আপনাকেই ভোগ করতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা প্রতিদিন এভাবে বাড়তি কাজের চাপ নিতে গিয়ে নিজের মস্তিস্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছি। যা শরীর আর কাজের পারফরম্যান্স দুটোর জন্যেই ক্ষতিকর। তাই সবসময়য় হাই ভোল্টেজে কাজ করতে গেলে একটা সময় আপনার মাথার তারই ছিঁড়ে যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, অনেক সময় বড় কোন দায়িত্ব নিতে গেলে কাজের চাপ একটু বেশি নিতে হতেই পারে তবে সেটা সঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারাই আপনার ম্যানেজমেন্ট স্কিল বা দক্ষতা। যদিও অনেক সময়, ‘আমি চাপ নিয়ে কাজ করতে পারি’ মনে করে কমবেশি সবাই অনেক কাজ নিয়ে হিমশিম খাই। যার ফলে একসঙ্গে অনেক দিকে মনোযোগ দেয়ায় কাজের মানও কমে যায়। একসময় এই খামখেয়ালিটাই অভ্যাসে পরিণত হয়। অর্থাৎ আমরা আজ না কাল, কাল না পরশু করে, সব কাজই একেবারে শেষ সপ্তাহে বা ডেডলাইনের ঠিক আগ মুহূর্তে শুরু করি। নিজেদের আমরা এই বলে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করি যে, এখনও যথেষ্ট সময় আছে হাতে। যদিও কাজের চিন্তা সবসময়ই আমাদের মানসিক চাপে রাখে। তাহলে কি উপায়?

       আপনি যদি প্রোজেক্ট ম্যানেজারের মতো কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন তাহলে এই বাজে অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে হলে দিনের শুরু থেকেই সতর্ক থাকতে হবে। প্রথমেই আপনাকে আপনার প্রতিদিনের কাজেগুলো থেকে বাছাই করে দেখতে হবে কোন কাজটি আপনাকে একাই করতে হবে আর কোন কাজটি আপনার সহকর্মীরা করতে পারবেন। যে কাজটি আপনি করতে পছন্দ করেন, কোন কাজটি আপনার জন্য জরুরী বা আপনি ছাড়া অন্য কেউ করতে পারবে না সেগুলোর তালিকা করে ফেলুন। এরপর বাদবাকিগুলো অন্য সহকর্মীদের বুঝিয়ে দিন।

কাজের পরিকল্পনা করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হোন। কাজের সময়সীমা বা ডেডলাইন সংক্ষিপ্ত করে ফেলুন। অর্থাৎ শেষ সময়ে কাজ জমা দেয়ার চিন্তা না করে নিজের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে নিন। আপনি হয়তো ভাবছেন, ডেডলাইন আগে নিয়ে আসলে সেটা বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে বাস্তবে সেটা হয় না, যেকোন কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার সিদ্ধান্ত নিলে বরং সেটিতে মনোযোগ দেয়া আরও সহজ হয় এবং দ্রুত করার তাগিদ অনুভূত হয়। ফলে আমরা আরও বেশি দায়িত্ববান হয়ে উঠি। এছাড়াও একটি কাজ শেষ করতে আপনার কত সময় লাগে সেটি নিয়মিত চেক করলেই দেখবেন, আপনি কাজের বাইরে কতটা বাড়তি সময় অপচয় করছেন। জরীপে দেখা যায়, আমরা সবাই যেকোন কাজ করতে কমবেশি ৫-১০% অতিরিক্ত সময় খরচ করি। টগল (Toggl) এর মতো অ্যাপগুলো ব্যবহার করেও আপনি আপনার কাজের পেছনে কত সময় খরচ করেন সেটি সহজেই নির্ণয় করতে পারবেন।

কিন্তু কাজ শুরুর আগেই যদি আপনি মানসিক চাপে থাকেন, সেটা থেকে রক্ষার উপায় কি?  দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলার জন্য আগে আপনাকে অপ্রয়োজনীয় টেনশন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেটার জন্য হালকা একটু ব্যায়াম করে নিতে পারেন। লো ইনটেন্সিটি এক্সারসাইজ যেমন অল্প কিছুক্ষণ একটু হাঁটাহাঁটি করে নেয়া বা স্ট্রেচিং এর মতো ছোটখাটো ব্যায়াম আপনার শরীরকে ক্লান্ত করে না। বরং দেহে রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে আপনাকে আরও কর্মঠ করে তোলে। এছাড়াও মনোযোগ বাড়ানোর জন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনাও জরুরী। চকলেট বা মিষ্টি জাতীয় খাবার অনেক সময় আমাদের বিষণ্ণতা দূর করে, ফলে কাজে মনোযোগ দেয়া সহজ হয়। ঘুমঘুম ভাব হলে এক কাপ কফিও ট্রাই করে দেখতে পারেন। কফি খেলে আমাদের মন সতেজ হয়, আর তাতে করে মনোযোগটাও বাড়ে। বিভিন্ন ধরণের বাদামও মানুষের মস্তিকের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে থাকে। এদিকে, অনেক গবেষক অফিসে কাজে মনোযোগ দিতে না পারার পেছনে সকালের নাস্তা না খেয়ে আসাকে দায়ী করেন।

এছাড়াও আপনি অন্যমনস্ক থাকলে কাজে মনোযোগ ফিরিয়ে আনার জন্যে বেশ কিছু কৌশল ব্যবহার করতে পারেন। মাইন্ডফুলনেস এর বিভিন্ন টেকনিক আপনার মস্তিষ্ক থেকে চারপাশের অপ্রয়োজনীয় দূর করে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে। এসব টেকনিকের মধ্যে সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় হচ্ছে, ‘পাঁচ চার তিন দুই এক’ নামের একটি টেকনিক। অনেকটা মনে মনে ধাঁধাঁ ধরার মতো। এটি আয়ত্ব করতে, শুরুতেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিন এবং ছাড়ুন। এরপর ঠাণ্ডা মাথায় এমন ৫ টি জিনিস চিন্তা করুন যা আপনি চোখে দেখতে পান, তারপর ৪ টি জিনিসের কথা ভাবুন যা আপনি স্পর্শ করতে পারেন, এমন ৩ টি জিনিস মনে করার চেষ্টা করুন যা আপনি শুনতে পান, ২ টি জিনিস ভাবুন যার ঘ্রাণ নিতে পারেন আপনি আর সবশেষে চিন্তা করুন এমন একটি জিনিসের নাম যা আপনি স্বাদ নিতে পারেন। এছাড়াও আরেকটি সহজ কৌশলে আপনি মনোযোগ এক জায়াগায় একত্রিত করতে পারেন, টেবিল গোছানোর মাধ্যমে। দ্রুত আপনার অফিসের টেবিলটি গুছিয়ে ফেলুন, দেখবেন আপনি আগের চিন্তার জগত থেকে চট করে বেরিয়ে এসেছেন।একসঙ্গে একাধিক কাজ করলে মনোযোগ ঠিক রাখা খুব কঠিন। কেননা মানুষের মনোযোগ একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে সর্বোচ্চ আট সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। তারপর অন্যদিকে সরে যায়। তবে মনোযোগ ধরে রাখার এসব নিনজা টেকনিক আপনার চিন্তাকে কাজের মধ্যে আটকে রেখে দ্রুত কাজ শেষ করতে সাহায্য করবে।

শেষ করার আগে আরেকটা কথা, নিজের মাল্টিটাস্কিং ক্যাপাসিটি চেক করার জন্য ভুলেও গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলতে যাবেন না।