ম্যানেজার হিসেবে আপনি কতটা সফল?

আপনি কি সর্বেসর্বা? ম্যানেজার হিসেবে সব কাজ একাই করেন? অফিসের কোন সিদ্ধান্তই কি আপনাকে ছাড়া হয় না? আপনাকে ছাড়া কি অফিস অচল?

প্রশ্নের উত্তর ভাবতে ভাবতে একটা গল্প শুনি চলুন। বেশ পুরোনো গল্প, হয়তো অনেকেরই জানা। তবে এখানে প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। …এক রাজসভায় সেনাপতি মন্ত্রীর উপর বেজায় অসন্তুষ্ট। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে তিনি মন্ত্রীর সঙ্গে একমত হতে পারেন না তিনি। তবুও রাজামশাই মন্ত্রীর কথাকে গুরুত্ব দেন। সেনাপতি একের পর এক যুদ্ধজয় করলেও মন্ত্রীর বেতন ছিল তার চাইতে বেশি।

শেষমেশ সেনাপতি রাজার কানে তুললেন সেসব কথা। কিন্তু অভিযোগ কানে তুললেন না রাজা। আরেকদিন রাজদরবারে সবার সামনে বলতে গেলেন সেনাপতি। রাজা বিরক্ত হয়ে থামিয়ে দিলেন তাকে। তারপর বললেন, রাজপ্রাসাদেরর প্রহরী কুকুরটির নাকি বাচ্চা হয়েছে! দেখেছেন?

সেনাপতি বললেন, জ্বি না হুজুর।

রাজা বললেন, যান গিয়ে দেখে আসুন।

সেনাপতি বাইরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এলেন।

দরবার শেষে সেনাপতিকে ডেকে পাঠালেন রাজামশাই। বললেন, ঘটনা কি সত্য?

সেনাপতি বললেন, জ্বী মহারাজ।

তা কয়টি বাচ্চা দিয়েছে? প্রশ্ন করলেন রাজা

তা তো দেখিনি। বললেন সেনাপতি। 

রাজা বললেন, যান, দেখে আসুন।

সেনাপতি কিছুক্ষণ পরই ফিরে এলেন।

– দেখেছেন? কয়টি বাচ্চা?

– জ্বি জাহাপনা, সাতটি।

– ছেলে কয়টি, মেয়ে কয়টি?

– আজ্ঞে, তা তো দেখিনি।

– যান, দেখে আসুন।

আবার ফিরে গেল সেনাপতি। আসার পর রাজার প্রশ্ন, কি দেখলেন?

– হুজুর, তিনটি ছেলে কুকুর, চারটি মেয়ে।

– আচ্ছা। কোনটির কী রং?

সেনাপতি উত্তর দিতে না পেরে মাথা চুলকাতে লাগলেন। রাজা এবার মন্ত্রীকে ডাকলেন এবং কুকুরের খোঁজ নিতে বললেন। মন্ত্রী দ্রুত খবর নিয়ে এলেন।

মন্ত্রীমশাই, ঘটনা কি সত্যি? বললেন রাজা।

– জ্বী, হুজুর।

– কয়টে বাচ্চা?

– আজ্ঞে, সাতটি হুজুর, তিনটি ছেলে, চারটি মেয়ে।

– কোনটির কী রং?

– জাহাপনা, দুইটি সাদা-কালো, চারটি সাদা আর একটি পুরোপুরি কালো রঙয়ের।

এবার সেনাপতির দিকে ফিরলেন রাজা। সেনাপতি মন্ত্রীর যোগ্যতা বুঝতে পেরে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললেন।

…এ গল্প পড়ে আমরা বুঝতে পারি, রাজা তার রাজদরবারের দায়িত্ব সঠিক লোকদেরই দিয়েছেন। এবং সবার কাজের মূল্যায়নও সঠিকভাবে হচ্ছে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে সেটা গল্পকারের দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা কি চিন্তা করে দেখেছি কখনো, রাজা কতটা অভিজ্ঞ আর বিচক্ষণ বলে খবরটির সত্যতা যাচাই করতে পারলেন? রাজদরবারের অন্যসব দায়িত্বে ব্যস্ত থাকলেও কুকুরের বাচ্চাগুলোর খোঁজ কিন্তু তিনি ঠিকই রাখেন। তাই মন্ত্রীর উত্তর যে সঠিক, তা ঠিকই বুঝেছেন।

এবার অফিসের গল্পে আসি। রাজা কিন্তু চাইলে নিজে গিয়ে কুকুরগুলোর খোঁজ নিতে পারতেন। কিন্তু তাতে তার গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময় অপচয় হতো। সেজন্য নিজে কাজটি না করে খোঁজ নিলেন সহকর্মীদের মাধ্যমে। কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্যে আলাদ কোন কোর্সও দরকার পড়লো না। একজনের কাজ দেখেই আরেকজন শিক্ষা পেলেন। তাহলে রাজার মতন ম্যানেজার সাহেব যদি অফিসের সবার কাজ ঠিকভাবে বন্টন করতে না পারেন বা ঠিক জায়গায় উপযুক্ত লোককে দায়িত্ব দিতে না পারেন, তাকে কি আমরা সফল বলতে পারি?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ম্যানেজারের প্রধান দায়িত্ব অন্যদের ‘দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া’ ও ‘কাজ আদায় করা’। তাই তদারকি করতে পারাটাই এখানে দক্ষতা। কেবল নিজের কাজ করতে পারা সবসময় জরুরি না। তদারকির জন্য বা নেতৃত্ব দেয়ার জন্য কৌশল, স্মার্ট চিন্তা আর নিয়মানুবর্তিতাও দরকার। অন্যদের ট্যালেন্ট বা মেধাকে উপলব্ধি করতে পারলে আর দক্ষতার সঠিক প্রয়োগ করতে পারলে ম্যানেজার হিসেবে কেবল সফলই হবেন না, একই সঙ্গে অফিসের কাজের পরিবেশটাই বদলে দিতে পারবেন আপনি। এমনকি নিজের কিছু দায়িত্বও শেয়ার করতে পারবেন সহকর্মীদের সঙ্গেও।

গবেষণায় দেখা গেছে, কোন প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজারের কাজগুলোর শতকরা ২০ ভাগ সুযোগ পেলে তার সহকর্মীরাও করতে পারেন। এতে ম্যানেজারের কাজের চাপ যেমন কমে, তেমনি অন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য হাতে যথেষ্ট সময় থাকে। আর জরীপের ফল বলছে, সহকর্মীদের সঙ্গে দায়িত্ব শেয়ার করলে ম্যানেজারের কাজের মান তো কমেই না বরং পুরো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদন বা আয় শতকরা ৩৩ ভাগ পর্যন্ত বাড়ে!!!

তাহলে ম্যানেজার হিসেবে আপনি সবার কাজের দায়িত্ব সঠিকভাবে বন্টন করছেন কি না, সেটা বুঝবেন কি করে?

– প্রথমত, এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে আপনি সারাদিন কাজের চাপে দিশেহারা এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকবেন। 

– আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা কমে যাবে। 

অর্থাৎ, কাজে ব্যস্ত থাকায় চিন্তা করার সময় পাবেন না। পরিকল্পনাগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দিনের বেশিরভাগ সময় পরিকল্পনার পেছনে ব্যয় করায় একসময় ম্যানেজাররা ক্লান্ত হয়ে যান। ফলে দিনের শেষভাগের সিদ্ধান্তগুলো কোন কাজে আসে না। ইংরেজিতে যাকে ‘ডিসিশন ফ্যাটিগ’ বলা হয়, অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মানসিক অবস্থা থাকে না তখন। তাই দিনের শুরুতে ঝটপট প্ল্যানিংটা সেরে নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তারপর সবার দায়িত্ব সবাইকে বুঝিয়ে দিলেই হলো।

– অফিসে কাজের গতি কমে যাবে। অর্থাৎ সব কাজের নেতৃত্বে যেহেতু আপনি একা আছেন, তাই কাজের বণ্টন ঠিকমতো না করতে পারলে কোনোকিছুই আগাবে না।

এখন আপনার যদি মনে হয়, সহকর্মীরা আপনার দায়িত্ব ভাগ করে পালন করার যোগ্য বা অভিজ্ঞ নন তাহলে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা করাও কিন্তু ম্যানেজার হিসেবে আপনার দায়িত্ব। আর যদি কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে আপনি নিজের দায়িত্ব অন্যকে দিতে না চান, তাহলে বুঝতে হবে সহকর্মীদের ওপর আপনার ভরসা নেই। নিজদের মধ্যে ‘ট্রাস্ট ইস্যু’ আছে। 

এ ধরণের গাফিলতিকে বিশেষজ্ঞরা সেলফ এনহ্যান্সমেন্ট বায়াস তথা অন্যকে প্রাপ্য মর্যাদা বা কাজের ক্রেডিট দিতে না চাওয়ার প্রবণতা মনে করেন। এদিকে এক গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৬০ ভাগ ম্যানেজার মনে করেন, তারা নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন। যদিও সহকর্মীরা তাদের সফল মনে করেন না। তাই একই কাজ সবসময় নিজে করার চাইতে সহকর্মীদের সুযোগ দিলে আরও ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

অনেক কর্মীই অভিযোগ তোলেন, তাদের বস কাজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কিছুই করছেন না। তাই সহকর্মীদের বড় দায়িত্ব দিতে হলে বা দক্ষভাবে গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে কাজের পারফরম্যান্স খুব দ্রুত বাড়ে। কর্মীরাও নিজেদের যোগ্যতা বা মেধার সঠিক ব্যবহার করতে পারেন। ফলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং আরও কর্মঠ ও দায়িত্বশীল হয়ে ওঠেন তারা। 

আর তাছাড়া কারো ওপর ভরসা করলে তিনি দায়িত্ব পালন করতে আরও বেশি আগ্রহী হন। তাই স্টাফদের খোঁজখবর নিতে এবং কার কোন বিষয়ে দক্ষতা আছে জানতে নিয়মিত সবার সাথে আলোচনা করা উচিৎ। অনেকসময় কর্মী নিজেই দায়িত্বের বাইরে নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে আগ্রহী থাকেন এবং সেজন্য নিজেকে তৈরি করতে চান। তাই প্রশিক্ষণের জন্য তার আলাদা আলাদা চাহিদা বা পছন্দ থাকতে পারে। তবে প্রতিবার প্ল্যান পরিবর্তন করার পর বা দায়িত্ব হস্তান্তরের পর কর্মীদের কাজের মান ও পরিমাণ নজরে রাখতে হবে। কারণ অতিরিক্ত কাজের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে কর্মীরা অমনোযোগী হয়ে ওঠতে পারেন, দক্ষতাও কমতে পারে। তাই কাজের সুষম বন্টনের সঙ্গে, নিয়মিত তদারকি ও প্ল্যান পরিবর্তন করা জরুরি। তেমনি ভালো কাজের জন্য প্রশংসা আর ভুলত্রুটির জন্য সংশোধনও প্রয়োজন।

দশের লাঠি একের বোঝা।

তাই সবাই মিলেমিশে কাজ করলে সবার সব কাজ সম্পর্কে কমবেশি ধারণা থাকে। ফলে দায়িত্ব হস্তান্তর বা কাজের বন্টন দুটোই ঠিকভাবে করা যায়। আর ম্যানেজার হিসেবে আপনার জনপ্রিয়তা আর সফলতা দুটোই নিশ্চিত হয়ে যায়!!!