আপনি কি ‘ডিসিশন ফ্যাটিগে’ ভুগছেন?

প্রতিদিন আপনি কতগুলো সিদ্ধান্ত নেন বলতে পারবেন?  বিশটি? পঞ্চাশটি?

যদি বলি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন? বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো?

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা এটাই প্রমাণ করেছে যে, দৈনিক আমরা বিভিন্ন ছোটখাটো কিংবা বড়সর ব্যাপারগুলোর জন্য প্রায় ৪০ হাজার পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেই। আপনি হয়তো ভাবছেন এটি কী করে সম্ভব! তাহলে আপনার প্রতি ঘণ্টার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে দেখুন। এই আর্টিকেলটি পড়ার আগেও কিন্তু আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে – আপনি এটি পড়বেন কি না। এরকম প্রতি মুহূর্তেই নানান সিদ্ধান্ত নিচ্ছি আমরা। উদাহরণস্বরূপ, আপনি অফিসে একসঙ্গে অনেকগুলো দিক সামলানোর সময় একটা কাজ রেখে আরেকটাতে মনোযোগ দিতেই অন্তত ৩০০ বার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

কিন্তু এই অল্প সময়ে আপনি যখন অনেকগুলো কাজ করার চেষ্টা করেন, তখন এটি আপনার ওপর এক ধরণের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ধীরে ধীরে আপনি ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে আপনার ‘সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা’ কমে যায়। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই অক্ষমতাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ইংরেজিতে বলা হয় ‘ডিসিশন ফ্যাটিগ’ বা সিদ্ধান্তহীনতাজনিত অবসাদ।

নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার মতো এই পরিস্থিতিকে অনেকে ইগো ডিপ্লেশনও বলে থাকেন। এই ডিসিশন ফ্যাটিগের কারণে আপনার মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়, আর তাই আপনি কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তখন আপনি চাইলেও কাজের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারেন না। তাই একটা নির্দিষ্ট সময় পর আমরা যত বেশি সিদ্ধান্ত নিতে থাকি তত বেশি ডিসিশন ফ্যাটিগে ভুগতে থাকি। তাহলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ওপর ডিসিশন ফ্যাটিগের প্রভাব কিরকম?

ডিসিশন ফ্যাটিগ আপনার খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজ এমনকি অফিসের কাজ পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারে। আপনি যদি আপনার মস্তিষ্ককে একসঙ্গে অনেকগুলো বিষয় মূল্যায়ন করতে বলেন কিংবা একই সময়ে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিতে চান, তাহলে আপনি একটি কাজও ঠিকভাবে করতে পারবেন না। বরং মস্তিষ্ক অসম্ভব ব্যস্ত থাকায় আপনি নিজের সামর্থ্যের বাইরে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে বা আবেগের বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করবেন। ধরুন আপনি একটা জিনিস কি কাজে ব্যবহার করবেন বা আপনার টাকা কোন খাতে কিভাবে ব্যয় করবেন সেটা নির্ধারণ করতে না পেরে হুট করে কিছু একটা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তখন যদি আপনার কেনা জিনিসটি কোন কারণে আপনার চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে কিন্তু আপনার পুরো টাকাটাই লস হবে। তাই ডিসিশন ফ্যাটিগ আপনার ব্যাংক ব্যালেন্সকেও অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

ধরুন আপনি একটা বাড়ি কিনতে চান। আপনি অফিসে কাজ করার সময় আপনার হঠাৎ সেকথা মনে পড়লো। কিন্তু আপনাকে যেহেতু অফিসে অনেক কাজের চাপের মধ্যে থাকতে হয় সেহেতু আপনার মস্তিষ্ক কাজের মধ্যেই সম্পৃক্ত থাকে সারাদিন। এদিকে বাড়ি কেনার জন্যেও যথেষ্ট পরিকল্পনা ও যাচাই বাছাই প্রয়োজন। কিন্তু ঐ অবস্থায় আপনি চাইলেও মানসিক চাপ আপনার মস্তিষ্ককে আপনাকে বাড়ি কেনার সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দিতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে আপনি বাড়ি কেনার জন্যে উদ্যোগ নিলে আপনার সিদ্ধান্তটি বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। আর বাড়ি বা জমির মালিকানা সম্পর্কিত তথ্য  সতর্কভাবে যাচাই না করে সেটি কিনতে গেলে পরিণতি কী হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘সিদ্ধান্ত’ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। সারাদিন আমরা যেসব সিদ্ধান্ত নেই তাঁর প্রত্যেকটি অনিবার্য এবং প্রয়োজনীয়। তবে, প্রতিদিন এই ‘সিদ্ধান্তের চাপ’ হ্রাস করার উপায়ও কিন্তু রয়েছে। তাছাড়া অফিসের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আবেগতাড়িত না হয়ে সচেতন ও বাস্তববাদী হতে পারলে কর্মক্ষেত্রে আপনার দক্ষতা এবং সৃজনশীলতাও বেড়ে যেতে পারে। তাই ‘ডিসিশন ফ্যাটিগ’ থেকে রেহাই পাওয়া খুব জরুরী। এই ডিসিশন ফ্যাটিগ এড়াতে তাহলে আমরা কি করতে পারি? নিচের টিপসগুলো মেনে চললে এই সমস্যা সহজে এড়ানো যেতে পারে।

যথাসম্ভব কম সিদ্ধান্ত নিন

বিশ্বাস করুন বা নাই করুন, ব্যক্তিগত এবং পেশাদার জীবনের বেশ কয়েকটি বিষয় আছে যা আপনি চাইলেই নিজের জন্য সহজ করে তুলতে পারেন।  আপনার বিভিন্ন বিল বা মাসিক খরচ পরিশোধের জন্য মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করুন।  আর কর্মক্ষেত্রে কম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দায়িত্ব অর্পণ করুন আপনার কলিগ বা অধীনস্থ কর্মকর্তার ওপর। তাহলেই দেখবেন আপনার এসব অপ্রয়োজনীয় চাপ কমে আসবে।

দৈনন্দিন কাজের একটি পরিকল্পনা বা রুটিন তৈরি করে ফেলুন

দৈনন্দিন জীবনে আমরা যদি নিয়মমাফিক কাজ করি তাহলে মন এবং শরীর এটিকে অভাসে পরিণত করতে পারে সহজেই। তাই কষ্ট হলেও নিজের প্রতিদিনের কাজগুলো সময়সূচী মেনে চলুন তাহলে সারা সপ্তাহ জুড়ে আপনি একটি ছন্দের মধ্যে থাকবেন। কাজের ছন্দপতন কেবল আপনার শরীরের ওপরই প্রভাব ফেলে না, আপনার পরবর্তী কাজের মনোযোগও নষ্ট করে দেয়। 

ডেইলি রুটিন খুব সহজেই আপনার মস্তিস্ককে কয়েক ডজন সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। যেমন কোন সময় ঘুম থেকে উঠতে হবে, সকালের কী খাবার খাবেন, কখন কি ব্যায়াম করবেন এবং কোন সময় ঘুমাতে যাবেন এই বিষয়গুলো যদি ছকে বাঁধা থাকে তাহলে আর এ নিয়ে ডেইলি ডেইলি মাথা ঘামানোর প্রয়োজন পড়ে না। নির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা মেনে চললে প্লেনের মতো শীঘ্রই আপনি অটোপাইলট মোডে চলে আসবে আর আপনার প্রতিদিনের রুটিন অনুসরণ করবেন। এই দৈনন্দিন কর্মপরিকল্পনা দিনের আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য আপনাকে মানসিক শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করবে।

দিনের শুরুতে বড় সিদ্ধান্তগুলি আগেভাগে গ্রহণ করুন

আপনি নিজেকে মর্নিং পারসন বা ইভিনিং পারসন যেটাই ভাবুন না কেন, যারা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তারাই কিন্তু সবক্ষেত্রে বেশি সফল হয়। অন্তত গবেষণাই এটাই প্রমাণিত যে, মানুষ দিনের শুরুতে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে বেশি পারদর্শী থাকে। সকালবেলা জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া বা কঠিন কাজগুলি করটা সহজ হয় কারণ আমাদের মস্তিষ্কের সবচেয়ে বেশি কার্যকর থাকে ঐ সময়টাতে।  অর্থাৎ আপনি রাত জেগে কাজ করে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেও দিনের বেলায় আপনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন সেগুলর চেয়ে রাতের বেলা গ্রহণ করা সিদ্ধান্ত অপেক্ষাকৃত বাজে হয়ে থাকে। যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাই একটা সম্পর্ক আছে। তাই আপনার দৈনন্দিন কাজগুলো সেই নিয়মমাফিক হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।

এই টিপসগুলো মেনে চললে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারটা আপনার জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। ফলে ডিসিশন ফ্যাটিগ থেকেও আপনি রক্ষা পাবেন।