আপনার অফিসের পরিবেশ কি বিষাক্ত?

প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট কারণে পরিবেশের ক্ষতি হলে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে। এই সংজ্ঞা হয়তো আমদের অনেকেরই জানা। কিন্তু পরিবেশ কি কেবল চার দেয়ালের বাইরেই দূষিত হয়?

যেকোনো প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি নির্ভর করে সেখানে কর্মীদের ভূমিকা বা পারফর্ম্যান্সের উপর। আর কাজের মান বা পারফর্ম্যান্স নির্ভর করে বেশ কিছু নিয়ামকের উপর। কাজের পরিবেশ তার মধ্যে অন্যতম। বিষাক্ত পরিবেশ যেমন শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি অফিসের পরিবেশ খারাপ হলে সেটি কর্মীদের জন্য এমনি প্রতিষ্ঠানের জন্যে বড় হুমকি। কাজের পরিবেশ কেন দূষিত হয় তা জানতে ক্যারিয়ার ও কর্মস্থল বিশেষজ্ঞদের একটি সাক্ষাৎকার নেয় ফোর্বসসহ বেশ কিছু বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন। বিশেষজ্ঞরা এমন ৭টি লক্ষণের কথা বলেন যা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন, একটি প্রতিষ্ঠানে কাজের পরিবেশ কতটা বিষাক্ত!

৭। যে অফিসে কর্মীদের দাবিদাওয়া মানা হয় না

অনেক প্রতিষ্ঠানই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছাড়া বাকিদের প্রতিক্রিয়া, পরামর্শ বা অভিযোগ আমলে নেয় না। এতে করে  অনেক কর্মীর কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হতে পারে। ফলে অফিসের কাজের পরিবেশকে সহায়ক মনে করতে পারেন না তারা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত মিটিং করতে হবে। আলচনার মাধ্যমে তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে প্রতিষ্ঠানকে। কর্মীরা যেন নিজের পরিচয় গোপন রেখেও তাদের অভিযোগটি জানাতে পারেন, সেটিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

৬। কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন হয় না

ভুলত্রুটির জন্য যেমন সংশোধন বা তিরস্কার প্রয়োজন, তেমনি ভালো কাজের জন্য প্রশংসা বা পুরষ্কারও সবার প্রাপ্য। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের ভালো কাজগুলোর মূল্যায়ন ঠিকভাবে হয় না। ফলে কর্মীরা কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কাজের পরিবেশ নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। ছোটবেলায় আমরা যখন পড়াশোনা করতে চাইতাম না তখন আমাদের বাবা-মা আমাদের নানা উপহার আর খেলনা কিনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেন যেন আমরা পড়াশোনায় আগ্রহী হই। এতে করে পড়ালেখার ভালো পরিবেশ তৈরি হতো। আমাদের ভালো কাজগুলোর জন্যেও সবাই প্রশংসা করে বলে আমরা তাতে আগ্রহ পাই। তাছাড়া উপহার পেতে সবাই পছন্দ করে। এবং সব কাজেই আমরা পুরষ্কার বা ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি আশা করি। কিন্তু কোনোভাবেই সন্তুষ্ট হতে না পারলে কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি আমরা। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের মস্তিষ্ক অনুপ্রেরণার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কেউ উপহার দিলে আমরা তার কাছে নিজের গুরুত্ব বুঝতে পারি। একইভাবে প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উপহার পেলে কর্মীরাও নিজেকে এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করেন। আর ভালো কাজে কোন প্রশংসা না পেলে নিজের মূল্যায়ন হচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

৫। যখন কর্মীদের কাজে আগ্রহ বা কাজের মান কমতে থাকে

আপনার প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা কি কাজের স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করছে না? নতুন কোন দায়িত্ব দিলেই কি সবাই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে বা ব্যস্ততার অযুহাত দেখাচ্ছে? ব্যস্ততা থাকতেই পারে তবে তার কারণ কি একেবারে যৌক্তিক? নতুন কোন প্রোজেক্ট বা কাজে হাত দিতে কি কেউ আগ্রহী হন না বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক কাজে ব্যয় করছেন সবাই? পরিস্থিতি যদি এমন হয় তাহলে বুঝতে হবে এখানে কাজের পরিবেশ খুবই খারাপ। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারা বা গুরুত্বপূর্ণ ডেডলাইন মিস করা কাজের পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরসরি কর্মীদের সবার সঙ্গে বসের আলাপ করা উচিৎ। ঊর্ধ্বতনদের তার অধীনস্থ কর্মীদের কাছেই জানতে হবে, কাজের মান ধরে রাখার জন্য তারা সঠিক সুযোগ পাচ্ছেন কি না। কিংবা প্রতিষ্ঠানে কি ঘাটতি আছে যার ফলে কাজের মান কমে যাচ্ছে?

৪। কর্মীদের মূল্যবোধের ঘাটতি ও দায়িত্বহীনতা দেখা দেয়া

অতিরিক্ত গল্পগুজব, আড্ডাবাজি বা কর্মস্থলে রাজনীতি কাজের পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। একইভাবে কর্মীদের নৈতিকতা বা মূল্যবোধ না থাকলে, কারো কোন আচরণগত সমস্যা থাকলে সেটি সহকর্মীদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে দায়িত্ববোধ বাড়ানোর জন্য কর্মীদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করা যেতে পারে। তবে মূল্যবোধ নিজ থেকে তৈরি না হলে তা সৃষ্টি করা খুব কঠিন। তাই কর্মীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ও প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা কঠোর করা প্রয়োজন। মানবসম্পদ বিভাগ বা এইচআরের ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কর্মীদের নিজেদের মধ্যে যাতে ভালো বোঝাপড়া থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কোন সমস্যা হলে প্রতিনিধি বা কোন একটি বিভাগের সবাইকে একসঙ্গে জবাবদিহি না করে, আলাদাভাবে প্রত্যেকের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে।

৩। কর্মীদের আচরণ ও শারীরিক ভাষায় লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে

প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিবেশ ভালো না হলে সেখানকার কর্মীরা সবসময় উদ্বিগ্ন ও অসন্তুষ্ট থাকেন। ফলে কাজের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে আসে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোন অফিস ছুটির পর যদি খেয়াল করে দেখেন সেখানকার কর্মীরা বিষণ্ণ মনে বাড়ি ফিরছে বা তাদের চলার গতি খুবই ধীর তাহলে বুঝতে হবে তারা চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট নন। অনেকক্ষেত্রে এটি কর্মীদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থারও মাপকাঠি। এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো প্রতিষ্ঠানেরই উচিৎ সেখানকার কর্মীদের খোঁজখবর নেয়া, তাদের সমস্যা গুলো জানতে বেশি বেশি প্রশ্ন করা।

২। যখন অতিরিক্ত কর্মী ছাটাই হয় বা পদত্যাগ বেড়ে যায়

কর্মী ছাটাই বা পদত্যাগের হার বেড়ে যাওয়াকে যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অপমানজনক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কর্মস্থলের জন্য এটি ভয়াবহ হুমকি বলেও উল্লেখ করছেন অনেকে। প্রতিষ্ঠানে নতুন কর্মীরা যদি বেশিদিন চাকরি না করেন বা দ্রুত অন্য কোথাও ভালো চাকরি পেয়ে চলে যান তাহলে বুঝতে হবে এখানে তাদের কাজের জন্য সঠিক পরিবেশ নেই। তাই প্রতিষ্ঠানের কোথাও কোন গাফিলতি আছে কি না, কোন সুযোগসুবিধার অভাব আছে কি না, সকলের সব অধিকার অভিযোগ বা দাবিদাওয়া আমলে নেয়া হচ্ছে কি না সেটা জানতে হলে কর্মীদের ইন্টার্ভিউ নেয়া আবশ্যক। তাই কেবল চাকরিতে যোগদানের সময় কর্মীদের ইন্টার্ভিউতে নিতে হবে এমন কোন কথা নেই, কেউ চাকরি থেকে অব্যহতি দিলে তার ইন্টার্ভিউ নেয়াটা আরও বেশি জরুরি।

 ১।  প্রতিষ্ঠানে সঠিক নেতৃত্ব অভাব দেখা দেয়

প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে বা ঊর্ধতন পর্যায়ে যারা দায়িত্বে আছেন তারা তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করতে না পারলেও অফিসের কাজের পরিবেশ খারাপ হতে পারে। গবেষকরা বলেন, বসদের যখন নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্যে থাকে তখন বুঝতে হবে তিনি তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। এগুলো হচ্ছে:

  • কাজের জন্য বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা বা কর্মীদের ওভারটাইম করতে বাধ্য করা।
  • মেধার সঠিক ব্যাবহার করতে না পারা। কার কোন দিকে দক্ষতা আছে সেটি উপলব্ধি না করে বা সামর্থ্য না বুঝে সবার কাছে সবকিছু আশা করা।
  • কাজের বন্টন ঠিকভাবে করতে না পারা বা সঠিক লোককে কাজের দায়িত্ব দিতে না পারা।
  • কর্মীদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ না করা।

অনেকসময় প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড বা ডিগ্রী একই বিষয়ে হলে বা সবাই একই প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা করলে সেখানে নতুনদের মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হয়। এছাড়াও কর্মস্থলে কর্মীরা যদি কাউকে বুলি করে বা হয়রানি করে এবং প্রতিষ্ঠান যদি এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেয় তখন সেখানে এ ধরণের আচরণ আরও বেড়ে যায়। ফলে অনেকেই সেখানে কাজের জন্য ভালো পরিবেশ পান না। অনেক বিশেষজ্ঞ এর জন্য অফিসের বিভিন্ন বিভাগ, টিম বা সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ বা সঠিক তথ্য আদান প্রদানের সুযোগ না থাকাকে দায়ী করেন। অফিসের নিয়মকানুনের ফাঁকফোকর থাকাও এর বড় কারণ। তবে উপরের এই ৭টি বিষয় মেনে অফিসে কাজের সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করাটা একটু কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু নয়!!!