বর্তমানের গতিশীল আর প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে উৎপাদনের হার বা কাজের পারফরম্যান্স বাড়ানো প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেরই প্রধান টার্গেটের পরিণত হয়েছে। আর তাই বিভিন্ন সেমিনার, পডকাস্ট, ওয়েবসাইট আর আর্টিকেলে কাজের অণুপ্রেরণা দিতে প্রচার করা হচ্ছে যে, “সদা জাগ্রত থাকুন” কিংবা এবং “ঘুম মৃতের মানুষের জন্য”।
অনেকেই বলে থাকেন, আমরা যদি দিনের প্রতিটা মিনিটের উপযুক্ত ব্যবহার করতে না পারি তার মানে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটা অনেকটাই সত্য। কর্মতৎপর না হলে উত্পাদন এবং মুনাফা দুটোই হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই সাফল্যের জন্য কিছু জিনিস বিসর্জন করা প্রয়োজন।
অনেকের কাছে এই বিসর্জনের তালিকায় ঘুম থাকে সবার আগে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কনট্রোলের তথ্যমতে, প্রাপ্তবয়স্কদের রাতে কমপক্ষে সাত ঘন্টা ঘুমানো উচিৎ, তবে সেটা সবার ক্ষেত্রে কার্যকর না। ঘন্টার পর ঘন্টা বেহুশের মতো পড়ে থাকাটা অনেকের কাছে আনপ্রোডাক্টিভ বা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৪০ ভাগ মার্কিন নাগরিক তাই দৈনিক ছয় ঘন্টা বা তার চেয়ে কম সময় ঘুমিয়ে থাকেন।
অতএব দেখা যাচ্ছে কর্মদক্ষতা আর ব্যবসার লাভের ক্ষেত্রে ঘুম বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে সেটা লাভের চাইতে কিন্তু লোকসানই বেশি করছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ বলছে, প্রতি বছর ঘুমের ঘাটতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জনপ্রতি ২ হাজার ২৮০ ডলার লোকসান হচ্ছে।
অর্থাৎ অপর্যাপ্ত ঘুমের ক্লান্ত শ্রমিক অন্যদের চাইতে কাজে অদক্ষ হয়ে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম বা ঘুম আপনার মস্তিস্ককে অনেক উপায়ে সহায়তা করে, সেটা নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে হোক কিংবা যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। দেহের রক্তপ্রবাহ ঠিক রাখা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রোগ নিরাময় আর শারীরিক সুস্বাস্থ্যের জন্যেও বিশ্রাম তথা ঘুম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর ঘুমের অভাব বিভিন্ন শারীর এবং মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তাহলে ঘুমের ঘাটতির প্রভাব কিভাবে ক্ষতি করে?
- অপর্যাপ্ত ঘুম দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে
- এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা দেখা যায়
- অস্থিরতার কারণে আমরা হুট করে মেজাজ হারিয়ে ফেলি
- কাজে মনোযোগের অভাব দেখা দেয়
কাজের পারফরম্যান্সের ওপরেও এর বেশ কিছু প্রভাব থাকতে পারে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব আমাদের শরীরকে অসুস্থতার দিকে নিয়ে যায়। ফলে প্রতিষ্ঠানে অসুস্থতাজনিত ছুটি নেয়ার হিড়িক লেগে যেতে পারে বা কর্মীরা দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। যেটা হয়তো সংক্রামক ব্যাধির মতো পুরো অফিসে ছড়িয়ে পড়বে।
মানসিক অস্থিরতার কারণে কর্মক্ষেত্রে সবার মধ্যে যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটে আর অফিসে হুটহাট উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এছাড়াও মনোযোগের অভাব কর্মীদের দক্ষতা কমাতে পারে, ভুলত্রুটি বাড়াতে পারে। একসময় পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে এই সমস্যাগুলোই চক্রাকারে ঘুরতে থাকে আর সবার মধ্যে মানসিক চাপ বাড়াতে থাকে।
কিন্তু ঘুমের ঘাটতি কেন হয়? আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মই এর মূল কারণ হতে পারে। সম্প্রতি অপর্যাপ্ত ঘুম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লেক্সিংটন ল ফার্ম একটি জরিপ করেছে। এতে দেখা গেছে যে প্রতি তিনজন মার্কিন নাগরিকের একজন কাজের চাপের কারণে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না।
যেকোন প্রতিষ্ঠানের ফিন্যান্স থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি বিভাগের কর্মকর্তারা এই সমস্যায় ভুগেন। কোন প্রতিষ্ঠান যদি দক্ষ এবং সুস্থ কর্মী চায় তাহলে অবশ্যই তাদের শান্তিতে ঘুমানোর সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ মানসিক চাপ কমাতে হবে। কর্মীদের ঘুম আর মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানও এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।
এখানে কর্মচারীদের মানসিক চাপ কমানোর কিছু উপায় উল্লেখ করা হলো:
শারীরিক সুস্থতার বিষয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন:
সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান কর্মীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষা এবং দক্ষতা বাড়াতে সুস্বাস্থ্যের ভূমিকা উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। এটা যে কোন প্রতিষ্ঠানে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। জরিপে দেখা যায়, ৬১ শতাংশ কর্মচারী তাদের কোম্পানিতে এ ধরণের আয়োজন থেকে সুফল লাভ করে থাকেন।
আর্থিক পরামর্শের সুযোগ করে দেয়া
বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ২৪ ভাগ মানুষ টাকা পয়সা এমনকি বেতনের চিন্তাতে রাতে ঘুমাতে পারেন না। তাই অর্থ উপার্জনের সঠিক উপায় আর অর্থ ঠিকভাবে বিনিয়োগ ও সঞ্চয় সম্পর্কে জানতে কর্মীদের বিশেষজ্ঞদের কাছে আর্থিক পরামর্শ নেওয়ার সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। এতে টাকাপয়সার চিন্তা কমবে, ঘুমের পরিমাণও আগের চাইতে বাড়বে।
সুস্থ ও সবল কর্মচারী উৎপাদনক্ষম এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাই ঘুম ঘাটতি ব্যবসার যেসব ক্ষতি করছে সে সম্পর্কে সবার সচেতন হওয়া জরুরি।